গীতার বাণীর উদ্দেশ্য কি?

গীতার বাণীর উদ্দেশ্য কি?

মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুকে গীতার বাণী দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য কি ছিল?
মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনকে দেখার পর; তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে এই চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন অর্জুন। তিনি তার সারথি শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন--- হে কৃষ্ণ! আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আগত আমার এই পরিজনদের দেখে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে যাচ্ছে, আমার মুখ শুষ্ক হয়ে আসছে, আমার শরীর কাঁপছে, আমার হাত থেকে গাণ্ডীব ধনুক খসে পড়ছে, আমার শরীরের ত্বক যেন জ্বলে যাচ্ছে, আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
হে কৃষ্ণ! আমি বিজয় কামনা বা রাজ্যসুখ ভোগের ইচ্ছা করি না, আমার আত্মীয় স্বজন আমাকে বধ করলেও আমি তাদের কে বধ করব না। যুদ্ধ না করার সপক্ষে অর্জুন আরো যুক্তি দেখিয়ে বলেন হায়! কী আশ্চর্য বিষয় যে, আমি রাজ্যসুখের লোভে স্বজনদের হত্যা করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। অতপর বিষাদগ্রস্ত অর্জুন এই কথা গুলো বলে তার ধনুর্বাণ ত্যাগ করে শোকাকুল চিত্তে রথে উপবেশন করেন।

অর্জুনের এই মানসিক অবস্থা দেখে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের বিমর্ষতা দূর করে; তাকে ধর্মযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই গীতার বাণী দিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে ন্যায়যুদ্ধ কেন সঙ্গত এবং কেন এটা ধর্মযুদ্ধ, যুদ্ধ করা কেন অর্জুনের কর্তব্য সেটা বুঝাতে গিয়ে গীতায় জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, সকাম কর্ম-নিষ্কাম কর্ম, পুনর্জন্ম, আত্মা আরো অনেক প্রসংঙ্গ এসেছে কিন্তু এইগুলা গীতার বাণীর মূল উদ্দেশ্য ছিল না। গীতার বাণীর উদ্দেশ্য ছিল ধর্মযুদ্ধ করা, দুষ্কৃতকারী দের বিনাশ করে ধর্ম সংস্থাপন করা। অর্জুন যখন যুদ্ধ না করার ইচ্ছায় ধনুবার্ণ ত্যাগ করেছিলেন তখনি শ্রীকৃষ্ণ তাকে ধর্ম যুদ্ধ করার জন্যই, দুষ্কৃতকারী এবং সেই দুষ্কৃতকারী দের যারা সঙ্গ দিয়েছিল তাদের কে; যারা তাদের সম্পত্তি দখল করেছিল, ধ্রুপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল, বিষ দিয়ে, অগুনে পুড়িয়ে নানা ভাবে হত্যা করতে চেয়েছিল, এবং প্রজাদের উপর অত্যাচার করত সেই পাপাত্মা দের কে বিনাশ করার জন্যই গীতার বাণী দিয়েছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ গীতার শুরুতে বলেন-- হে অর্জুন! এইরুপ সঙ্কটে কোথা হতে অনার্যের মত শোকানল, তোমার হৃদয়ে কিভাবে উপস্থিত হল? তুমি কাতর হইও না, ইহা তোমার উপযুক্ত নহে। হৃদয়ের দূর্বলতা পরিত্যাগ করে উত্থিত হও, তুমি উঠে দাড়াও। তুমি প্রাজ্ঞের মত কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়, সেই বিষয়ে শোক করছ। যারা জ্ঞানী তারা কখনও জীবিত বা মৃত কারো জন্যই শোক করে না। শরীর বিনষ্ট হলেও আত্মা কখনো বিনষ্ট হয় না। তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে, সবাই তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে, তোমার শত্রু পক্ষের সমস্ত মহারথীরা মনে করবে যে তুমি ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ, অতএব তুমি যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উত্থিত হও। অর্থাৎ অর্জুন কে ধর্মযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই, দুষ্কৃতকারী দের বিনাশ করার জন্যই শ্রীকৃষ্ণ গীতার বাণী দিয়েছিলেন, এটাই ছিল গীতার বাণীর মূল উদ্দেশ্য।

কিন্তু আমরা গীতার বাণীর মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কি করছি?
কেও গীতা গ্রন্থের উপরে ফুল, তুলসী দিয়ে পূজা করছে, মানুষ মারা গেলে তার বুকের উপর গীতা দিচ্ছে; কেও গীতা পড়ে হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ জপ করছে, কেও গীতা পাঠ করে পুণ্য অর্জন করে স্বর্গে যেতে চাইছে, কেও জয় গীতা, জয় গীতা বলে চিৎকার করছে, কেও গলায় তুলসী মালা, কোপালে তিলক দিয়ে গীতা পাঠ করে ব্যবসা করছে। এইসব বেজাল ধর্মচর্চা আর কুসংস্কারের ফলে গীতার প্রকৃত উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে গেছে। আর আমরা দিনের পড় দিন একটা দূর্বল অসামর্থ্য বান জাতি তে এবং সবার স্বীকারে পরিণত হচ্ছি।
● সত্যমেব জয়তেঃ


লিখেছেন: শিমুল চৌধুরী

No comments

Theme images by LordRunar. Powered by Blogger.