স্বর্গ অর্থ কি?
স্বর্গের সন্ধানে সুপ্রাচীন দার্শনিক
শবর স্বামী ও কুমারিল ভট্ট
স্বর্গ শব্দের মূল অর্থ প্রীতি(সুখ), পরে অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘অন্তহীন নিরন্তর সুখ’ কিন্তু পূর্বপক্ষ স্বর্গশব্দের অর্থ করেছেন সুখকর বস্তু(দ্রব্য), যা থেকে সুখ পাওয়া যায়। এ মতের মর্ম দাঁড়াচ্ছে- সুখ নিছক একটা অনুভুতি নয়, প্রধানত সুখ বলতে বুঝতে হবে সুখের উৎসস্বরুপ বস্তুটি। ‘সুখ ও সুখকর বস্তুর মধ্যে সুখটাই প্রধান, সুখ পাব বলেই বস্তুটি পেতে চাই, শুধু পাওয়ার জন্য কে কবে কোন কিছু পেতে চেয়েছে। তাই স্বর্গ শব্দের অর্থ নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ। স্বর্গশব্দের মূল অর্থ প্রীতি বা সুখ। কিন্তু পূর্বপক্ষ বলছেন সুখকর দ্রব্যটাই স্বর্গ। প্রমাণরুপে লৌকিক বাক্যব্যবহার তুলে ধরেছেন-
কৌশেয়ানি সূক্ষ্ণাণি বাসাংসি স্বর্গঃ
চন্দনানি স্বর্গঃ দ্ব্যষ্টবর্ষা স্ত্রিয়ঃ স্বর্গঃ
(সূক্ষ্ণ রেশমবস্ত্র স্বর্গ, চন্দন স্বর্গ, ষোড়শী নারী স্বর্গ- মী. সূ. ৬/১/১ পৃ.১৩৪৭)
সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপক্ষ একথাও বলেছেন যে এগুলি আলংকারিক বাক্য নয়, বস্তুনিষ্ঠ ব্যবহার।
এরপরে পূর্বপক্ষ একটা গুরুতর প্রশ্ন তুললেন। আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, স্বর্গ বলতে সাধারণ লোকে বোঝে মৃত্যুর পরপারে কোনো লোক বা দেশ ‘যেখানে শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, নিরানন্দ নেই, গ্লানি নেই, শুধু পুণ্যবানরাই মৃত্যুর পর যেখানে যায়, অন্যরা নয়। তা হলে লোকপ্রসিদ্ধি না মেনে যজ্ঞের দ্রব্যটাকে স্বর্গ বলছেন কেন?
তা হলে বলছি- স্বর্গলোকে কেউ না ম‘রে যেতে পারে না। আর মৃত্যুর পর সেখান থেকে ফিরে এসে বলতেও পারে না। স্বর্গ দেখে এসেছি, বড়ো আনন্দের দেশ। অনুমানের দ্বারাও জানার উপায় নেই (কারণ, প্রত্যক্ষের সহিত সম্পর্কশূন্য অনুমান হয় না।) অন্য কোনো প্রমাণের দ্বারাও জানা যায় না। যদি বলেন, কোনো কোনো সিদ্ধ মহাপুরুষ দেখে এসেছেন, দেখে এসে পৃথিবীর মানুষকে বলেছেন। না, এরূপ সিদ্ধমহাপুরুষ কেউ আছেন বা ছিলেন, যিনি স্বর্গলোক দেখে এসে মানুষকে বলেছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। যদি বলেন, বেদে পুরাণে এরকম কত কাহিনি আছে তাও প্রমাণ নয়। পুরাণ গুলি মানুষের তৈরি কল্পকাহিনি, আর বেদে স্বর্গের উল্লেখ তো অর্থবাদমাত্র। তাই কোনো মানুষের সঙ্গে স্বর্গের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই গল্পের দ্বারা কিছু প্রমাণ হয় না। যা কোনদিন কারুর প্রত্যক্ষ নয় এমন কোনো কল্পিত দেশ নিয়ে মানুষের ব্যবহার বা কাজকারবার চলে না।
স্বর্গ শব্দের অর্থ যদি নির্ভেজাল সদানন্দ হয়, তবে এহেন আনন্দ সংসারে দুর্লভ। তাই অর্থের সঙ্গতিরক্ষার জন্য অর্থাপত্তি প্রমাণের দ্বারা এমন কোনো দেশ বা লোকের কল্পনা করতে হয় যেখানে অন্তহীন অবিমিশ্র সুখ সম্ভব। সেই মৃত্যুপারীর্ণ পরদেশ বা পরলোকটাই স্বর্গ।
পূর্বপক্ষ বলছেন- তাহলেও তো আমাদের কথাই রইল। শেষপর্যন্ত ঐ হল, সুখটাই স্বর্গ নয়, সুখের সাধন বস্তুটাই স্বর্গ(কোনো স্থান বা লোক)। কিন্তু না মরলে সেখানে যাওয়া যায় না সেই লোকব্যবহারের অতীত, কল্পিত অনন্ত সুখের আধার স্বরুপ স্বর্গলোকে জীবন ছেড়ে পাড়ি জমাবার জন্য বহুব্যয় বহুশ্রম ও বহুসময়সাধ্য যাগযজ্ঞ জীবিত মানুষ করতে যাবে কোন দুঃখে। তা ছাড়া আপনারা মীমাংসকরাও তো মৃত্যুর ওপারে কোন কল্পিত স্বর্গলোকের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
মীমাংসক সিদ্ধান্তপক্ষেরও যে এই মত একথা কুমারিল ভট্ট স্বীকার করেছেন এবং সেভাবেই শাবর ভাষ্যের ব্যাখ্যা করেছেন। কুমারিল বলছেন- সিদ্ধান্তমতে স্বর্গশব্দের অর্থ প্রীতি, পূর্বপক্ষমতে প্রীতিকর বস্তু। কিন্তু কোনো মতেই মরণোত্তর কোনো দেশ বিশেষ বোঝায় না। উভয়মতে যুক্তিটা একই- যা মানুষের প্রত্যক্ষের নিতান্ত অযোগ্য এমন এক কল্পিত ব্যবহারাতীত পরলোক নিয়ে মানুষের জীবনে কোনো কাজ চলতে পারে না। তাই বৈদিক বাক্যে প্রযুক্ত স্বর্গশব্দের অর্থ পরলোক হতে পারে না। ভাষ্যে অর্থাপত্তিপ্রমাণের দ্বারা স্বর্গলোকের কল্পনা করা যেতে পারে বলে যে কথা বলা হয়েছে তা ‘অভ্যুপগমবাদ’ অর্থাৎ যেমন আমরা বলি ‘ধরুন তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে…. তবুও কিন্তু…..’। শবর-স্বামী পরলোকের বিরুদ্ধে যুক্তিটা পূর্বপক্ষের মুখে বসিয়ে দিলেও এটা তারও মত। মীমাংসারও সিদ্ধান্ত কুমারিল একথাই বোঝাতে চাইছেন। তফাৎটা একটা জায়গায়- পূর্বপক্ষ সুখকর দ্রব্যটাকে স্বর্গ বলছেন এবং ‘স্বর্গকামো যজেত’ এই বিধিবাক্যের অর্থ করছেন, ‘স্বর্গদ্বারা(সুখকর দ্রব্য দ্বারা) যজ্ঞ কর। সিদ্ধান্তপক্ষ বলছেন, এরূপ অর্থ করলে প্রীতি বা সুখ গৌণ হয়ে পড়বে, যজ্ঞটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াবে। সুখলাভ না হলে কে যজ্ঞ করতে যাবে?
সুতরাং বিধিবাক্যটির অর্থ হবে, ‘যজ্ঞের দ্বারা স্বর্গ (সুখস্বাচ্ছন্দ্য) লাভ কর। তাহলে সব মিলে সিদ্ধান্তটা এরুপ দাঁড়াচ্ছে,- ‘সুখলাভের জন্যই যজ্ঞ করতে হবে। পরলোক বলে কিছু নেই যেখানে নিরন্তর অন্তহীন সুখ সম্ভব। ইহলোকেও অবিমিশ্র নিরবচ্ছিন্ন সুখ পাওয়া যায় না একথাও সত্যি। সুতরাং, যজ্ঞের দ্বারা ইহলোকেই যতদূর সম্ভব প্রচুর সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভের চেষ্টা কর। এটাই মর্মার্থ।
(সংগৃহীত)
1 comment
আমরা কি জানতাম যে আমরা জন্ম নেবো? জন্মের আগে জানতাম যে পৃথিবী ও মানবসমাজ বলতে কিছু আছে? মনে করবেন, পৃথিবী একটা স্টেপ। যিনি আত্মা নামক জিনিসটার রক্ষক তিনি চাইলে স্বর্গের থেকেও বড় কিছু দিতে পারে। বর্তমানের অপ্রাপ্তি যেনো কখনো আমাদের হতাশ না করে ফেলে। মহাবিশ্ব কতো বড় বলতে পারেন? এই মহাবিশ্ব কিভাবে এসেছে জানি না। তবে এটা জানি দুর্বল মানব জাতীর থেকেও ক্ষমতাধর কোনো শক্তি আদিতেও ছিলো আর অন্তেও থাকবে। এই মহাবিশ্বের আদী অন্ত বলে কিছু নেই। শুভ কামনা রইলো আপনার মূল্যবান চিন্তার প্রতি।
Post a Comment